তবলার ঘরানা

তবলার ঘরানা নিয়ে আজকের আলোচনা। তবলা ঘরানা গুলো বেশিরভাগ পরিবারের মধ্যেই বিস্তৃত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে এসে পরিবারের বাইরে বিস্তৃতি বেড়েছে।

তবলার ঘরানা

তবলার ঘরানা

দিল্লি ঘরানা:

ভারতে তবলা বাদন দিল্লি থেকে শুরু হয়েছে এমন কথাই প্রচলিত। তবলা বাদন শুরু করেন সিধার খাঁ (সুধার খাঁ নামেও পরিচিত)। দিল্লি ঘরানার প্রথম বাদক ও প্রতিষ্ঠাতাও তাকেই ধরা হয়। যেহেতু তিনি দিল্লির অধিবাসী ছিলেন, সেখান থেকেই বাদন শুরু ও তার উত্তরসূরিরাও দিল্লির, তাই এ ঘরানার নাম দিল্লি ঘরানা আর বাদনকৌশল দিল্লি বাজ নামে পরিচিত। সিদ্ধার্থ খাঁর তিন পুত্র ছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে বুগরা খাঁ ও ঘাসিট খাঁর নাম পাওয়া যায়। তৃতীয় পুত্রের নাম অজানা। এই তিনজনের পাশাপাশি রোশন খাঁ, কাল্লু খা ও তুল্লন খাঁ মূলত দিল্লি ঘরানাকে এগিয়ে নিয়েছেন।

দিল্লি ঘরানার বাদন বৈশিষ্ট্য হলো এতে তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে তবলায় আঘাত করে বোল তোলা হয়। এছাড়া তবলার কিনার বা চাটীতে বোলের কাজ করা হয় বেশি। এ কারণে দিল্লি বাজের আরেকটি নাম ‘কিনার কা বাজ’। দিল্লি বাজে ছোট মুখরা, মোহরা, কায়দা, পেশকার, রেলা ইত্যাদির প্রতি মনোযোগ বেশি দেয়া হয়। দিল্লি বাজে ধিন, ধিনম তেটে, তেরেকেটে, ক্রেধাতেটে, ঘেনাটেতে, ধেটেতেটের প্রয়োগ বেশি।

তবলার অন্যান্য ঘরানারও সূতিকাগার দিল্লি ঘরানা। এ ঘরানার বাদকরা নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন এবং নতুন নতুন বাদনকৌশল তথা ঘরানা তৈরি করেন। দিল্লি ঘরানা বহু বিখ্যাত বাদক তৈরি করেছে। এর মধ্যে বুগরা খাঁর দুই পুত্র সিতাব খাঁ ও গুলাব খাঁ অন্যতম। এ ঘরানারই আহম্মদ জান খিরকুয়া ভারতে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

 

 

অজরাড়া ঘরানা:

দিল্লির কাছেই মীরাটের একটি গ্রাম অজরাড়া। সেখানে একটি ঘরানা তৈরি হয়েছিল। এরই নাম অজরাড়া ঘরানা। অজরাড়া গ্রামের অধিবাসী দুই ভাই কাল্লু খাঁ ও মীরু খাঁর হাতে এ ঘরানার পত্তন হয়। অজরাড়া গ্রাম থেকে শুরু হওয়ার কারণে এর নাম অজরাড়া ঘরানা। দিল্লি থেকেই তবলার অন্যান্য ঘরানার সূচনা। অজরাড়া ঘরানার পেছনেও আছে দিল্লির অবদান। কেননা কাল্লু ও মীরু ছিলেন সীতাব খাঁর শিষ্য। দিল্লিতে তারা সীতাব খাঁর কাছ থেকে তবলা বাদন শেখেন ও পরে নিজেদের গ্রামে এসে এতে কিছু পরিবর্তন করে নতুন ঘরানা তৈরি করেন।

দিল্লি বাজের সঙ্গে অজরাড়া ঘরানার বেশ মিল আছে। পার্থক্য বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কায়দার অসাধারণ প্রয়োগ। আড় বা দেড়িয়া লয়ে প্রয়োগ করা হয় কায়দাগুলো। এছাড়া গৎ, পেশকার ইত্যাদির রূপও অনেকটা কায়দার মতো। তবে দিল্লি বাজের সঙ্গে অজরাড়া বাজের একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে অজরাড়া বাজে বাঁয়ার কাজ থাকে বেশি।

অজরাড়া ঘরানায়ও বেশ কয়েকজন বাদক বিখ্যাত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কাল্লু খাঁর পুত্র মহম্মদ বখশ, পৌত্র চাঁদ খাঁ ও প্রপৌত্র কালে খাঁ অন্যতম। কালে খাঁর পুত্র হাস্সু খাঁ ও পৌত্র শামসু খাঁও নাম করেন।

 

 

লক্ষৌ ঘরানা:

এ ঘরানারও শুরুয়াত দিল্লি ঘরানার ওস্তাদদের হাত ধরে। আজরাড়ার সঙ্গেও এর শুরুর মিল আছে। সিধার খাঁয়ের তৃতীয় প্রজন্ম থেকে এ ঘরানার শুরু। মদু খাঁ ও বকসু খাঁ নামে দুই ভাই তবলার নতুন কিছু বাদনকৌশল তৈরির চেষ্টা করেন। লক্ষেৗয়ে মুসলিম নবাবরা মূলত কত্থকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বিশেষত ওয়াজিদ আলী শাহ্ ও তার পূর্বপুরুষের সম্পর্কে এ কথাই বলা হয়। কত্থকের সঙ্গে মদু ও বকসু তবলা বাজাতেন। এর মধ্য দিয়ে তারা তবলা বাদনের নতুন বাজ খুঁজে পান। তারা কত্থকের সঙ্গে বাজানো পাখোয়াজ ও তবলার বাদনশৈলী থেকে নিজেদের মতো বাদনকৌশল শুরু করেন। এতে পূরবী বাজের ব্যবহার বেশি থাকে।

লক্ষৌ ঘরানার বাদনবৈশিষ্ট্য হলো এতে তাপিয়া বাজ নামে একটি নতুন ধারা আনা হয়েছিল। এ ধারায় হাতের তালু ব্যবহার করে বোল তোলা হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে আঙুল ব্যবহার করে বোল তোলা হয়।

মদু খাঁ, বকসু খাঁর পাশাপাশি এ ঘরানায় ওয়াজিদ হুসেন খাঁ, আবিদ হুসেন খাঁ, আফাক খাঁ ও জাহাঙ্গীর খাঁ জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

 

 

বেনারস ঘরানা:

লক্ষৌ ঘরানার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বেনারস ঘরানা। এ ঘরানার প্রধান পুরুষ ছিলেন রাম সহায়। তিনি ছিলেন মদু খাঁর শিষ্য। পণ্ডিত রাম সহায় ১২ বছর লক্ষৌ তবলা বাদন শিখেছিলেন। তার জন্মভূমি বেনারস। শিক্ষা শেষে তিনি বেনারস ফেরেন এবং সেখানে নতুন এক বাদনশৈলী পরিচয় করিয়ে দেন। মূলত রাম সহায়ের ভাই জানকী সহায় ও ভাইয়ের ছেলে গৌরী সহায় ও তার পুত্র ভৈরব সহায় এ ঘরানার প্রধান বাদক ছিলেন।

বেনারস ঘরানার বৈশিষ্ট্য এতে লগগী, লড়ী, ছন্দ, গৎ ইত্যাদির প্রয়োগ থাকে। এছাড়া বড় পরণ, কায়দা পেশকার থাকে। পাখোয়াজ অঙ্গের বোল বা বার্ণের আধিক্য থাকে। আওয়াজ বেশ গম্ভীর হয়। বাঁয়া ব্যবহারের পাশাপাশি খাব লব ও গাবের কাজ বেশি থাকে।

লক্ষৌ ঘরানার সেরা বাদক হিসেবে বলদেব সহায়ের নাম করা হয়। তিনি ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া কিষণ মহারাজ, পণ্ডিত শান্তাপ্রসাদ, নান্নু সহায়ও এ ঘরানা প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন।

ফরুখাবাদ ঘরানা:

এ ঘরানার সূতিকাগার লক্ষৌ। বখসু খাঁর জামাতা হাজি বিলায়েত আলী খাঁর হাত ধরে শুরু হয় ফরুখাবাদ ঘরানা। এ ঘরানার সেরা তবলিয়া হিসেবে নাম আসে নানহে খাঁ, মসীত খাঁ ও কেরামৎ খাঁর। এরা সবাই হুসেন আলী খাঁয়ের বংশের পুরুষ। হুসেন আলী ছিলেন বিলায়েত আলী খাঁর পুত্র।

ফরুখাবাদ ঘরানার বাজ মূলত লক্ষৌ ও বেনারসের মতোই। পূরবী বাজের কাজ এ ঘরানার বাদনে দেখা যায়। তবে এ ঘরানায় গতের চাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সুন্দর। একক বাদনের ক্ষেত্রে এ ঘরানায় উঠানের আগে পেশকার বাজানো হয়।

এ ঘরানার বাদকদের মধ্যে আরো নাম করা যায় মসীত খাঁর শিষ্য ওস্তাদ মুন্নে খাঁ, শ্রীজ্ঞান প্রকাশ ঘোষ ও শ্রী রাইচাঁদ বড়ালের।

 

 

পাঞ্জাব ঘরানা:

ভারতের ছয়টি ঘরানার মধ্যে পাঞ্জাব ঘরানা স্বকীয়। কেননা অন্যান্য ঘরানা একটি আরেকটি থেকে এসেছে। পাঞ্জাবের সঙ্গে এদের যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। পাঞ্জাব ঘরানার সূচনা করেছেন হুসেন বখশ।

পাঞ্জাব ঘরানায় বাজের ক্ষেত্রে পাখোয়াজের প্রভাব বেশি দেখা যায়। এখানে খোলা বোল, বন্ধ বোলে পরিণত হয়। কায়দার ক্ষেত্রে বড় কায়দাই এখানে থাকে। এছাড়া পেশকার, গৎ ও পরণের ব্যবহার থাকে। এ ঘরানার বাদনের আগে কিছু কৌশল ব্যবহার করা হয়। বাজানোর আগে বায়ার গাবে আটা ময়দা লাগানো হয়। এতে আওয়াজ গভীর হয়। আর এ ঘরানার বাদনে পাঞ্জাবি ভাষারও প্রভাব লক্ষণীয়।

পাঞ্জাব ঘরানায় হুসেন বখশের পুত্র ফকীর বখশকে সেরা বাজিয়ে হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া তার পুত্র কাদির বখশও একজন অসাধারণ বাদক ছিলেন। ওস্তাদ আল্লারাখা বখশ মূলত কাদির বখশেরই শিষ্য।

যেকোনো ঘরানার সঙ্গে ওস্তাদ-শিষ্যের একটি সম্পর্ক আছে। ঘরানার মূল জ্ঞান ওস্তাদ তার শিষ্যকে দেন। এভাবেই ঘরানা এগিয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওস্তাদ কখনো নিজ বংশেরই হতে পারেন। তবে সেখানে পিতা, দাদা বা বড় ভাইকে পরিবারের সদস্যের চেয়ে একজন গুরু হিসেবেই বেশি সম্মান করা হয়। ভারতে ঘরানার সিলসিলা এভাবেই চলে এসেছে। আধুনিক সময়ে এসে পুরনো সেই ধারা ততটা নেই কিন্তু এখনো তবলা বা অন্য যেকোনো বাদ্যের ক্ষেত্রে ঘরানার প্রভাব আছে। আজ তবলার যে বাদন তা তৈরি করে দিয়েছে ঘরানাই। তাই তবলার ক্ষেত্রে ঘরানার ঐতিহ্য দৃশ্যমান না হলেও বাজনা, বোলের আড়ালে ঘরানা বেঁচে আছে।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment