আজক আমাদের আলোচনার বিষয় তবলার জন্ম কথা। তবলার জন্মরহস্য নিয়ে তীব্র মতভেদ ও নানাপ্রকার গাল-গল্পের আজও শেষ নেই। অনেক সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তির মতে, – আমীর খসরু সেতার ও তবলা আবিষ্কার করেছিলেন, মৃদঙ্গকে ( পরবর্তীকালে মুসলমান আমলে পাখোয়াজ ) দু’ভাগে ভাগ করে ভারতীয় সঙ্গীত সমাজে তবলার প্রবর্তন হয়। এই মতবাদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তবলার জন্ম কথা
হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগের শেষে এবং মুসলমান যুগের অবসানের কিছু আগে ধারক হিসেবে গীত ও বাদ্যের অনুশীলনকে তৎকালীন মুসলমান ও হিন্দু সমাজ বাঁচিয়ে রাখলেও ঐতিহ্য এবং শাস্ত্র-আলোচনা আর সঠিক আদর্শরক্ষার দিকটা কিছুটা অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়েছিল, একথা ঐতিহাসিক মাত্রেই স্বীকার করবেন। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নাট্যশাস্ত্রে মুনি ভরত পুস্কর ও মৃদঙ্গের কথা বলেছেন ।
আবার ওদিকে আচাৰ্য অভিনব গুপ্ত নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকায় বলেছেন— ‘দ্বাতি’ নামে একজন ঋষি পুষ্করবাত্য আবিষ্কার করেন। পুষ্কর মৃদঙ্গজাতীয় বাহ্য এবং তার শব্দ মেঘগর্জন ও মেঘবর্ষণের মতোই শোনাতো । মুনি ভরত নাট্যশাস্ত্রে বলেছেন— মৃদঙ্গ ও পুষ্কর মৃত্তিকা নির্মিত। আবার খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শাঙ্গ দেব তাঁর মহামূল্যবান গ্রন্থ ‘সঙ্গীত- রত্নাকরে’ বলেছেন যে, মৃদঙ্গ খয়ের, রক্তচন্দন প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরী হ’ত।
সুতরাং মুনি ভরত ও ঋষি শাঙ্গ দেবের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় যে, ‘মৃদঙ্গ’ ও ‘পুস্কর’ সূচনায় মৃত্তিকা দিয়েই তৈরী হ’ত। তবে পরবর্তীকালে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল । অতি প্রাচীনকালে বৃন্দবাস্থ্যে ( অর্কেষ্ট্ৰ। ) মৃদঙ্গ ও পুষ্কর বাজানো হ’ত। এগুলি চর্মজাতীয় বাদ্যযন্ত্র এবং চর্মজাতীয় বাদ্যযন্ত্রগুলিকে বলা হয় অবনদ্ধ। চর্মজাতীয় বাতযন্ত্র বলতে এই বুঝতে হবে যে, এগুলির অগ্রভাগ বা মুখ চর্মদ্বারা আবরিত ।
নৃত্য, কণ্ঠসঙ্গীত, বৃন্দগায়ক ও বৃন্দবাস্থ্যে একের অধিক পুষ্কর বা মৃদঙ্গ বাজানো হত । এইসব অনুষ্ঠানে একসঙ্গে তিনটি পর্যন্ত পুষ্কর বাজানো হ’ত। তিনটি পুষ্করের মধ্যে হু’টি সমান আকারের (বর্তমান পাখোয়াজের মতো) এবং একটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের থাকত। বড় পুষ্কর ছুটি সোজাভাবে দাঁড় করানো আর ছোট পুষ্করটি থাকত শায়িত ।
তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, ‘খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকে ভুবনেশ্বরের মুক্তেশ্বর-মন্দিরে, বম্বে নগরীর বাদামী-মন্দিরে নৃত্যশীল নটরাজের পাশে পুষ্কর বাদ্যগুলির চিত্র খোদাই করা আছে। অনেকে মনে করেন ‘ছুটি সোজাভাবে দাঁড়ানো এবং একটি শোয়ানো পুষ্কর বা মৃদঙ্গের অনুকরণেই পরবর্তীকালে ( মুসলমান যুগে ) তবলা বা তলমৃদঙ্গ ও বাঁয়া বা বামমৃদঙ্গের প্রবর্তন হয়।

খ্রীষ্টীয় ১৩শ থেকে ১৭শ শতক সময়ের মধ্যে খেয়াল-গানের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তবলা ও বাঁয়ার ক্রমোন্নতি ও বহুল প্রয়োগের দৃষ্টাস্ত পাওয়া যায় । একথা স্বীকার করতেই হবে যে, খেয়াল-গানের সঙ্গে সঙ্গত করবার জন্যই সর্বপ্রথম তবলার প্রয়োজন হয় এবং ধীরে ধীরে তবলা খেয়াল-গানের সঙ্গে সঙ্গত করবার জন্য ব্যবহার হতে থাকে।
মুসলমান রাজত্বের শুরুতে যখন আঞ্চলিক গ্রাম্যনীতিরূপে কাবালী ( কাওয়ালী )- সহেলার প্রচলন ছিল, তখনই তবলা-বাঁয়ার অপরিণত রূপের সৃষ্টি হয়েছিল, একথা অনেকেই মনে করে থাকেন। তালরক্ষার জন্যই তবলা ও মৃদঙ্গবাছের অবশ্য প্রয়োজন। এইজন্য তবলা ও পাখোয়াজকে ‘ভাল’ যন্ত্র বলা হয়। ভারতবিখ্যাত ওস্তাদ মসীদ খান সাহেবের ( আমার তবলার গুরু) তবলার ক্রিয়াত্মক ( Practical Demonstration) এবং ঔপপত্তিক (Theoretical) জ্ঞান অসাধারণ।
তবলার সমুদ্র বললেও বোধকরি বেশী বলা হয় না । তিনি বিভিন্ন দেশ- বিদেশে ভ্রমণ করে তবলার বহু গূঢ় তথ্য সংগ্রহ করেছেন কঠোর পরিশ্রম করে। তবলার জন্ম-ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর অভিমত হলো :-
‘পুরাকালে বিদ্যাদেবী ভারতী নারিকেলের ওপরটা চামড়ায় আচ্ছাদিত করে একরকম বাজনা তৈরি করেন। এই বাজনাটার নাম ছিল—ভাল-তরঙ্গ। তারপর গৌতম-বুদ্ধ পাথর কুঁদিয়ে তা থেকে একরকম বাদ্যযন্ত্র তৈরি করলেন— নাম দিলেন ভবন-জাং। পাঞ্জাব প্রদেশে এর এখনো প্রচলন আছে এবং সেখানকার লোকে এ-জাতীয় বাতযন্ত্রটাকে বলে – ‘ধামা’ বা ‘দুঝড়’।
এর পর আরবদেশের লোকেরা এর অনেক পরিবর্তন করেন। চন্দ্রপাল এবং আনন্দপালের সময়ে যখন তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করবার জন্য কম্বোজে এলেন, তখন তারা ‘তবল-জাং’কে কাঠের রূপ দিলেন— নাম দিলেন ‘তবলা’। তাঁরাই বায়ার প্রচলন করেন। পূর্বে ধায়ার প্রচলন ছিল না। ‘তবলা’ আরবী নাম।
সুতরাং ভবলার ক্রমপরিবর্তিত রূপ হলো তিনটি :
(১) ভাল-ভরঙ্গ (পুরাকালে )
(২) ডবল-জাং (বৌদ্ধযুগে )
(৩) গুলা (আরবযুগে )।
আরও দেখুন :