আজক আমাদের আলোচনার বিষয় তবলা শিক্ষার সূচিপত্র
Table of Contents
তবলা শিক্ষার সূচিপত্র
ভূমিকা
খেয়াল গানের সঙ্গে সঙ্গত করবার জন্যই সর্বপ্রথম তবলার প্রয়োজন হয় এবং ক্রমশঃ তবলা খেয়াল গানের সঙ্গে সঙ্গত করবার জন্য ব্যবহার হ’তে থাকে। মসলমান রাজত্বের প্রারম্ভে যখন বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম্যগীতি রূপে কাবালী বা কাওয়ালী, সাহনার প্রচলন ছিল, তখনই তবলা ও বাঁয়ার অপরিণত রূপের সৃষ্টি হয়েছিল । আন,মানিক খ্রীষ্টীয় ১৭৩৮ সালে, দিল্লীর মুঘল বাদশা মহম্মদ শা’র শাসনকালে, তানসেনের কন্যার বংশের নিয়ামৎ খাঁ ছিলেন তৎকালের শ্রেষ্ঠ যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী।
তানসেনের জামাতা ছিলেন মিশ্রী সিংঙ্গী। এর সঙ্গে তানসেনের কন্যা সরবতীর বিবাহ হয়। মিশ্রী সিংজী ছিলেন অদ্বিতীয় বীণকার। সম্রাট আকবর শা’ নিজ রাজদরবারে তাঁকে বহ; সাধ্যসাধনা করে তানসেনের ধ্রুপদ গানের সঙ্গে বীণায় সহযোগিতা করবার ব্যবস্থা করেছিলেন। মিশ্রী সিংঙ্গী ছিলেন রাজপতে। অত্যন্ত ধার্মিক এবং সাধক। নিয়ামত খাঁ ছিলেন এই মিশ্রী সিংজীর বংশধর। নিয়ামত খাঁ ছিলেন মহম্মদ শার রাজদরবারের অন্যতম বীণ-বাদক।
কিন্তু, সে সময় যন্ত্রের কদর কন্ঠসঙ্গীতের মতো ছিল না। নবাব মহম্মদ শা’ কন্ঠসঙ্গীতের অতিশয় ভক্ত ছিলেন। কাজেই, নিয়াম খাঁ তাঁর রাজদরবারে একরকম অনাদৃত শিল্পীর,পেই ছিলেন । মহম্মদ শা’ তাঁকে যথোচিত সম্মান না দেওয়ায় তিনি মর্মাহত হয়ে একদিন রাজদরবার পরিত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন। নিয়াম খাঁ কঠোর সাধনা করতে লাগলেন কন্ঠসঙ্গীতের। কয়েকটা বছর পেরিয়ে গেলো।
একদিন দিল্লীর রাজপথ দিয়ে নিয়াম খাঁ হেটে চলেছেন। সহসা এক স্থানে দেখতে পেলেন- দুটি ভিখারী বালক (জানি রসল ও গোলাম রসূলে ) অপূর্বে মিষ্টি গলায় গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। ওদের কন্ঠ শনে নিয়াম খাঁ মুগ্ধ হলেন। সঙ্কল্প করলেন, ঐ দুটি ভিখারী বালককে নিজের গহে প্রতিপালিত করে কন্ঠসঙ্গীতে তালিম দেবেন । যেমন সঙ্কল্প, তেমনি কাজ । নিয়াম খাঁ সেইদিনই ঐ দুটি ভিখারী বালককে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন নিজগৃহে।
ওদের প্রতিপালন করতে লাগলেন আর সেই সঙ্গে কণ্ঠসঙ্গীতে শিক্ষা দিতে লাগলেন। সদেীর্ঘ এক যুগে, মানে ১২টা বছর ওদের কন্ঠসঙ্গীতে শিক্ষা দিলেন। সলতান আলাউদ্দীনের রাজদরবারের অদ্বিতীয় সঙ্গীতবিদ, এবং পণ্ডিত ও কবি আমীর খসর ও পরবর্তীকালে সলতান হাসেন শাহ্, প্রবর্তিত কাওয়ালী গানের রীতি পদ্ধতিতে আলাপ এবং ধ্রুপদ গানের একটা মিলনসেতু রচনা ক’রে এক অভিনব খেয়াল গান (খাল) পরিবেশনের পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন।
বর্তমানকালে আমরা যে খেয়াল গানের চাল- চলনের সঙ্গে পরিচিত, তার আকিকর্তা হলেন নিয়াম খাঁ। দিল্লীর অদ্বিতীয় গায়ক ফিরোজ খাঁ ( অদারঙ্গ ) এবং ভপেৎ খাঁ ও ইন্দোরের আমীর হোসেন খাঁ (জীবিত) এই নিয়ামৎ খাঁর-ই বংশধর। যাহোক, ঐ বালক দুটিকে ১২ বছর শিক্ষা সমাপনান্তে একদিন নিয়ামত খাঁ মহম্মদ শা’র রাজ-
চার
দরবারে পাঠিয়ে দিলেন কন্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করতে। ঐ বালক দুটি জানি রসলে আর গোলাম রসলে তখন বয়সে তরণ ।
ওরা রাজদরবারে কন্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করবার অনুমতি পেল স্বয়ং নবাবের কাছ থেকে । ওরা সঙ্গীত পরিবেশন করলো রাজদরবারে।
করলেন :-
জবাব এলো ওদের মুখে থেকে :—
নবাব মহম্মদ শা’ সাপ্তিশর মগ্ধ হলেন ওদের কন্ঠের অপূর্বে খেয়াল গান শুনে। জিজ্ঞাসা —কে তোমাদের সঙ্গীত শিক্ষার গল্পে, ?
— নিয়ামত খাঁ সাহেব।
শানে নবাবের দঃখ আর অন,শোচনার অন্ত রইল না। তিনি নিজেকে সহস্র ধিক্কার দিলেন- গণীর কদর না বঝে তিনি নিয়াম খাঁকে অবজ্ঞা করেছিলেন। মহম্মদ শা’ তৎক্ষণাৎ তাঁর লোক-লকরদের আদেশ করলেন— এখনি চুনিয়াম খাঁ সাহেবকে
আমার দরবারে নিয়ে এসো।
আদেশ পাওয়া মাত্রেই লোক লস্কর ছটলো নিয়ামৎ খাঁ সাহেবের বাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে হাজির করলো নবাবের কাছে। নবাব তখন এই মহাসঙ্গীতরণেীকে দাহাতে যাকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তাঁর সিংহাসনের পাশে সাদরে বসালেন। তারপর ক্ষমা প্রার্থনা করলেন তাঁর কাছে। শ,ষ, এই নয় । নবাব মহম্মদ শা’ নিয়াম খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন এক লক্ষ মোহর প্রণামী দিয়ে।
আর নিয়ামত খাঁকে ‘শা’ সদারঙ্গ’ উপাধিতে অলঙ্কৃত করলেন। নিরাম খাঁ আবার নবাব মহম্মদ শার রাজদরবারে প্রতিষ্ঠিত হলেন ।
এই শা’ সদারঙ্গ নিয়ামৎ এই আধুনিক খেয়াল গানের জন্মদাতা। আজীবন নবাবের থেকে তিনি অসংখ্য খেয়াল গান সৃষ্টি করে গেছেন। এই সব খেয়াল গান উত্তরোত্তর প্রসি লাভ করতে থাকলে, এর সঙ্গে সপ্নে কাজে সঙ্গত করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এদিকে রহমন খাঁ নামে সেকালে একজন বিখ্যাত পাখোয়াজী ছিলেন। তাঁর এক পত্রের নাম ছিল- আমীর খসর। ( ইনি
আম্রাউদ্দীনের সমরের আমীর খসরা নন) রহমন খাঁর পর আমীর খসর; শা’ সদারঙ্গ নিয়ামত খাঁর
শিক্ষা দেওয়া থেয়াল গানের সঙ্গে তালযন্ত্রে সঙ্গত করবার জন্য পাখোয়াজের অন করণে তবলা বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেন।
বিঞ্চ পরের প্রসিদ্ধ কন্ঠসঙ্গীত শিল্পী গদাধর চক্রবর্তীর ছোট ভাই—মরলীধর চক্রবর্তী দিল্লীতে গিয়ে শা’ সদারঙ্গ নিয়ামং খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে খেয়াল গান শিক্ষা করেন। শিক্ষা সমাপনে তিনি (ম,রলীধর) যখন দিল্লীতে ফিরে আসেন, তখন বিষ্ণু পরের প্রখ্যাত গায়ক অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে (সঙ্গীত নায়ক গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা) অবহিত করেন।
শা’ সদারঙ্গ নিয়ামত খাঁ যখন খেয়াল গানের প্রবর্তন করলেন, তখন, খেয়ালের সঙ্গে পাখোয়াজ বাজিয়ে সঙ্গত করা হ’ত। কিন্তু, পরে খেয়ালগানের আরো উন্নতি হ’লে শা’ সদারঙ্গ নিয়ামৎ খাঁই পাখোয়াজকে খেয়ালগানের সঙ্গে সঙ্গত করা
পাঁচ
অম্ল,পযোগী বলে ঘোষণা করলেন। অতঃপর খেয়ালগানের সঙ্গে মদ, আওয়াজে সঙ্গত করবার জন্য ভিন্ন ভাল-যন্ত্রের প্রয়োজন হওয়ায় শা’ সদারঙ্গ নিয়ামৎ খাঁরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য আমীর খসরা (রহমন খাঁর পত্র) খেয়ালগানের সঙ্গে মদ, আওয়াজে সঙ্গত করবার উপযোগী একটি তাল-যন্ত্র আবিষ্কার করলেন, এবং সেই তাল-যন্ত্রটি আধনিক তবলা । তবলার প্রয়োজনয়ীতা বেশী ক’রে দেখা দেয় মধ্যযুগের নিরামৎ খাঁ’র সময় থেকে।
একথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক বস্তুই অনঃশীলনের দ্বারা উন্নতি এবং প্রসারতা লাভ করে । তবলা বাদ্যযন্ত্রটির ক্ষেত্রেও অবশ্য এটা ঘটেছে। ভবলার আকর্ষণীয় বাদনশৈলীর মধর রূপে দেন দিল্লীর প্রসিদ্ধ ওস্তাদ সিন্দুরে বা সিধার খাঁ । দিল্লী ঘরাণার উৎপত্তি এই সিন্দর বা সিধার খাঁ থেকেই হয়, এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তিনি পাখোয়াজের কঠিন ও বড় বড় বোল-বাণী ভেঙ্গে সংক্ষ থেকে সক্ষেতের এবং সক্ষতের থেকে সক্ষেতম করলেন।
কঠিন থেকে সহজ এবং প্রতিমধুর ক’রে তবলার এক বিশেষ ধরনের হাত প্রচলন করলেন। সৃষ্টির দিক দিয়ে ওস্তাদ সিন্দুর খাঁ বা সিধার খাঁর তবলা জগতে অবদানের আর তুলনা নেই । সম্ভবতঃ ইংরাজীর ১৭০০ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে তবলার সমধিক প্রচলন হয়। সিদুর খাঁ বা সিধার খাঁর বংশপরম্পরায় ও শিষ্যবর্গ থেকে তবলার সমধিক প্রচলন এবং উন্নততর বাদনশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। এখন এই ভবলার বইখানি সম্বন্ধে আলোচনায় আসা যাক ।
অনেকে প্রশ্ন করেন তবলা শিক্ষা করতে গেলে দৈনিক কত ঘন্টা করে রেওয়াজ করা দরকার ? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়–এর তেমন কোনো সঠিক ঘড়ি ঘণ্টার নির্দেশনামা নেই। যার যেমন ক্ষমতা, যার যেমন সময় তার সেইমতো ভবলা রেওয়াজ করা উচিত। তবে ভোরের দিকে দ ু’ঘণ্টা, এবং রাত্রে দশটার পর রেওয়াজ করতে পারলে ভালো হয়। এর কারণ আর কিছুই ময় ভোরবেলায় এবং রাত্রের দিকটা সব নিরিবিলি থাকে।
এই সময় ভাই মনও ভালে৷ বসে। একটা নিয়ম অবশ্য পালন করা দরকার। ফটকুই রেওয়াজ করা হোক না কেন, তার মধ্যে সত্যিকারের নিয়মনিষ্ঠা এবং প্রয়োজনমতো আত্মপ্রতায় থাকা চাই। এই আত্মপ্রত্যয় না থাকলে কোনো দিনই কোনো মহৎ কাজ বা কোনো মহৎ সাধনা ফলপ্রসূ হ’তে পারে না। যে কোনো বোল তবলার রেওয়াজ করার সময় প্রথমে একহারা লগ্নে (ঢিমা) ধীরে ধীরে হাত বসিয়ে বাজানো দরকার।
রেওয়াজ করার সময় তবলা ও বাঁরার আওয়াজ যাতে ঠিকমত ওঠে সে চেষ্টা করা উচিত। তবে এটা মনে রাখতে হবে, ভাল রেওয়াজ করার হাত এক, আর তা পরিবেশন বা সঙ্গত করার হাত আর এক। সেখানে শব্দকে সংযত করা দরকার। হাতকে পরিবেশনকালীন সংযত করতে না পারলে, সেটা বাজনার মধ্যে গিয়ে পড়বে। অনেকে এই সজোরে রেওয়াজ করার অভ্যাসটা সঙ্গতেও প্রয়োগ করে বসেন।
এতে গায়ক বা যন্ত্রশিল্পীর এবং শ্রোতাদের মন অস্থি করে তোলে। হাতের দাপট, মানে এই নয় যে, খুব জোরে শব্দ করে তাল বাজাতে হবে। হ! দাপট মানে তবলা ও ধারায় হাতের যথোপযুক্ত ‘কস’। আর একটা কথা, ‘ত্রিতাল’ হলো সেরা তাল। এই তালের আর জড়া নেই। যিনি এই তালটি রপ্ত করতে পারবেন, ভাল রপ্ত করতে সময় লাগবে না। তালা শাস্ত্রে ও বাদ্যে যত সব উৎকৃষ্ট ধরনের বোল-
ছয়
তার অধিকাংশই ১৬ বা ৮ বা ৪ বা ২ মাত্রার ভাগে গঠিত। এই তালের বোল-বাণী অন্যান্য তালেও ব্যবহার করা যায়। শখে, কিঞ্চিৎ মননশীলতা এবং বাম্বির দরকার।
আমার এই গ্রন্থখানির মধ্যে যে-যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, তা অবশ্যই প্রথম শিক্ষার্থ থেকে আরম্ভ করে অগ্রসর শিক্ষার্থীদের পক্ষেও উপযন্ত । ভবলার ‘জন্মকথা’, ‘তাল ও লয়’, ‘তালের জাতি বিভাগ’, ‘ছন্দ বৈচিত্র্যা’, ‘তাল ও মাত্রাসহ বিভিন্ন তালের ঠেকা’, ‘সমপদী ও বিসমপদী তালের ঠেকা’, ‘তবলায় উত্থিত বোল-বাণী বা শব্দ’, ‘তবলার হস্তপাড়’, ‘তবলার বাণীর পরিভাষা’,
‘তবলা বাঁধার সাধারণ নিয়ম’, ‘হস্ত সাধনার সাধারণ নিয়ম বা পদ্ধতি’, ‘হস্ত সাধনায় বোল-বাণী’ ‘তাল ও মাত্রাসহ বিভিন্ন বোল-বাণী’ – ( কায়দা, রেলা, পেকার, গৎ, মখেরা, পাল্লাদার গং, চলন, টংক বা ও চক্রদার প্রভৃতি ), কণ্ঠ এবং যন্ত্রসঙ্গীত তবলার সঙ্গত করার সাধারণ নিয়ম’, ‘একক বা তবলা লহরা বাজাৰায় নিয়ম’, ‘তবলা রেওয়াজ করার সাধারণ নিয়ম এবং তবলিয়াদের নানারকম মদ্রাদোষ সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশা করছি – শিক্ষার্থী এবং তবলা সম্বন্ধে উৎসকে ব্যক্তি মাত্রেরই এই সচিত্র ‘তবলা শিক্ষা’ পস্তেকখানি বিশেষ কাজে লাগবে ।
সূচিপত্র
প্রথম অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়
- তবলার বাণীর পরিভাষা
- তবলা ও বাঁয়ার অবয়বের বিবরণ
- তবলার সুর বাঁধার মিল্পম
- হস্ত সাধনার নিয়ম বা পদ্ধতি
- হস্ত সাধনার বোল বাণী
- হপ্ত সাধনার বিভিন্ন প্রকার রেলা
পঞ্চম অধ্যায়
আরও দেখুন :