তবলার বর্ণ : আমাদের আজকের আলোচনা, তবলার বর্ণ নিয়ে। পৃথিবীর যেকোনো ভাষার মতন সংগীতও একটি স্বতন্ত্র ভাষা। অন্যসব ভাষার ন্যায় সাংগীতিক ভাষারও রয়েছে বর্ণের সঠিক উচ্চারণ তথা ব্যাকরণ। তবলা কিংবা পাখোয়াজের বোল বা বাণীকেই বলা হয় তবলার বর্ণ। তবলার এই বর্ণগুলোর মধ্যে যা এক হাতে বাজে, সেগুলোকে বলা হয় সরল বর্ণ, আর দু’হাতের বর্ণের নাম সংযুক্ত বর্ণ। আলাদাভাবে দু’হাতের সরল বর্ণ এবং সংযুক্ত বর্ণ মিলে ১০ টি মৌলিক বর্ণ তৈরি হয়। এবার বর্ণগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়া যাক।
![পর্ব ৩ঃ তবলার বর্ণ [ সহজ তবলা শিক্ষা ] - Anatomy of Tabla, Percussion instrument, तबला, ताल वाद्य यंत्र, তবলার বিভিন্ন অংশ, তাল বাদ্য](https://tablagoln.com/wp-content/uploads/2022/03/Anatomy-of-Tabla-Percussion-instrument-तबला-ताल-वाद्य-यंत्र-তবলার-বিভিন্ন-অংশ-তাল-বাদ্য-4.jpg)
Table of Contents
তবলার বর্ণ [ সহজ তবলা শিক্ষা ]
ডান হাতের সরল বর্ণ (ডায়নার জন্য প্রযোজ্য )।
১– তা অথবা না:
এই বর্ণ দ্বারা তবলার (ডায়না) স্পষ্ট “সা” শোনা যায়। এই শব্দটি তর্জনী দিয়ে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে বাজাতে হয়। তুলনামূলক সহজ এই বাণী রপ্ত করা। মূল আঘাতের যায়গা কিছুটা বদলে এই বর্ণের আওয়াজের তীক্ষ্ণতায় আনা যায় বৈষম্য। তবলার কিনার অথবা কানিতে আঘাত করলে তীক্ষ্ণ “তা” এর শব্দ উৎপন্ন হয় এবং “সুর” নামের যায়গাটিতে আঘাত করলে তুলনামূলক কম তীক্ষ একটি এর আওয়াজ শোনা যায়। এই দুই ধরনের “তা” অথবা “না” কে, কিনার এবং সুরের “তা” বলেই সম্বোধন করা হয়।
২– তি অথবা তিন :
এই বর্ণে একটি স্পষ্ট “সা” শোনা গেলেও, এই আওয়াজ “তা” এর তুলনায় অনেকটা মসৃণ শোনায়। লাখনাউ ঘরানার তবলা মহারথি পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর এই নির্দিষ্ট বাণীর স্পষ্টতার প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। অনেকক্ষেত্রেই, বোল বলার সুবিধার্থে, “তি” কে “তিন” বলেও সম্বোধন করা হয়। তর্জনী দিয়ে মাঝের কালো অংশ (গাব/সিহাই) এবং এর ঠিক পরেই তবলার সাদা অংশের (ময়দান) ঠিক মাঝখানে একটি বিশেষ কায়দায় আঘাত করলে একটি সুন্দর “তা” বর্ণ উৎপন্ন হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে, এই বাণীটি আনতে কিছুটা বেগ পেতে হতে পারে। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে, দ্রুত এই বাণী আয়ত্তে আনা সম্ভব।
৩– দিন :
এই বাণীটি, মূলত পাখোয়াজ থেকে আগত। তবলার আদি যন্ত্র পাখায়াজ। একটি উল্লেখযোগ্য জনশ্রুতি হলো- পাখয়াজ থেকেই তবলার উৎপত্তি। অনেকক্ষেত্রেই, পাখোয়াজ থেকে সরাসরি নেয়া অথবা অনুপ্রাণিত অনেক ছন্দ, বোল এবং রচনা বাজানো হয় তবলাতে। “দিন” বর্ণের আওয়াজ বেশ খোলা এবং শক্তিশালী। তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা এবং কনিষ্ঠা চারটি আঙ্গুল দিয়েই গাবের মাঝ বরাবর আঘাত করতে হয় এই বর্ণে। সব ধরনের তবলার বাজনায় এই বাণীর প্রয়োগ থাকলেও, বেনারশ ঘরানায় এই বর্ণের বিশেষ প্রয়োগ লক্ষণীয়।
৪– তুন/থুন:
এই বর্ণের বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকাংশেই মিলে যায় “দিন” বর্ণের সাথে। ধারণা করা হয়, এটিও পাখোয়াজ থেকেই আগত। “দিন” বর্ণের তুলনায় “তুন” বর্ণের আওয়াজ অনেকটাই মসৃণ। তর্জনী দিয়ে গাবের ঠিক মাঝখানে আঘাত করলে বেশ সহজেই এই শব্দ উৎপন্ন করা সম্ভব।
৫– তে/তি:
এই বর্ণ একটি বন্ধ শব্দ। অর্থাৎ এই শব্দের রেশ নেই। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বর্ণটি আয়ত্তে আনাও বেশ সহজ। ডায়না/তবলার গাবের ঠিক মাঝখানে, মধ্যমা, অনামিকা এবং কনিষ্ঠা দিয়ে একটু জোর দিয়ে আঘাত করলেই এই আওয়াজ আয়ত্তে চলে আসবে।
৬– টে/রে :
এই বর্ণের আওয়াজ প্রায় “তে” এর মতই। অনেকক্ষেত্রেই, “তে” এর পরিপূরক হয় “রে” অথবা “টে”। এই শব্দ বের করাও বেশ সহজ। তবলার গাবের ঠিক মাঝখানে, তর্জনী দিয়ে আঘাত করলেই “টে” বর্ণ বাজানো সম্ভব।

বা হাত/ বায়ার সরল বর্ণ
৭– কাত/কে/:
এই বর্ণটির বন্ধ আওয়াজ। এই শব্দের রেশ নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে, উচ্চারণ বা কাব্যিক সুবিধার্থে একে কাত, কত, কে, কি, ক বলেও সম্বোধন করা হয়। বায়ার উপরে (যে হাতে বায়া বাজানো হবে সেই হাত দিয়ে) তবলার গাব হাতের মাঝে ফেলে কিছুটা জোর দিয়ে পাঁচ আঙ্গুলে আঘাত করলেই “কত” বর্ণ শুনতে পাওয়া যাবে।
৮- ঘে:
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বর্ণটি বায়ার প্রকৃত আওয়াজ শোনায়। তবলা “সুরের” ভাজ এবং আবেদনের মূল কাজগুলো করা হয় এই বর্ণের ব্যাবহার করেই। বায়াতে আলতোভাবে হাত রেখে, মধ্যমা এবং অনামিকার সম্মিলিত একটি বিশেষ আঘাতে এই বর্ণের প্রকৃত আওয়াজ উৎপন্ন করা যায়। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্যে এই বর্ণের সঠিক আওয়াজ রপ্ত করা কিছুটা কষ্টসাধ্য হতে পারে, তবে তা নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে দ্রুত সহজ করে ফেলা সম্ভব।

উভয় হাতের সংযুক্ত বর্ণ :
৯ – ধা:
এই বাণীটি উৎপন্ন হয় দু’হাতের ব্যবহারে। ডায়না/তবলার “তা” এবং বায়ার “ঘে” একই সাথে আঘাত করলে এই শব্দ উৎপন্ন হয়।
১০– ধিন:
এই বর্ণের আওাজ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ঠ অনেকটাই “ধা” এর মতই। ঠিক “ধা” এর মতন “ধিনে”ও বায়াতে একই রকম ভাবে “ঘে”, এবং অন্য হাত দিয়ে তিন বাজাতে হবে। এই দুটো বর্ণ এক সঙ্গে বাজলেই “ধিন” আওয়াজ উৎপন্ন হবে।
আঠেরো শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত, তবলার বাজনায় ক্রমশ যোগ হচ্ছে নতুনত্ব। একাধিক নতুন বর্ণের সংজোযনও চোখে পড়বার মতো। স্বর্গীয় পন্ডিত শঙ্কর ঘোষ তাঁর লেখা একটি গ্রন্থে তবলার মৌলিক বাণীগুলোর সাথে একই মর্যাদায় আরো চারটি নতুন বাণী যুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। বর্ণ চারটি হলো-“ধেরে”, “তেনে”, “তারাং” এবং “তিত”।
তবলার বর্ণ নিয়ে তবলা গুরুকুলের ইউটিউব চ্যালেল এবং ফেইসবুক পেইজে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় পৃথক দু’টি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে, যা নতুন শিক্ষার্থীদের তবলার বর্ণ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান আহরণ করতে খুবই সহায়তা করবে, দেখবার আমন্ত্রন রইল।
আরও পড়ুন:
ভিডিও: