ভারতীয় তবলা সঙ্গীত: ঐতিহ্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষ

ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে তবলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য বাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিত। এর জটিল ছন্দ, বহুমাত্রিক স্বর ও অত্যাশ্চর্য শব্দের কারণেই তবলা সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। তবলায় পারদর্শী শিল্পীরা এই বাদ্যযন্ত্রকে একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা ভারতীয় সঙ্গীতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই নিবন্ধে আমরা তবলায় ব্যবহৃত ছন্দ, শৈল্পিক উদ্ভাবনা এবং তবলার প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা করব।

ভারতীয় তবলা সঙ্গীত: ঐতিহ্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষ

তবলার ইতিহাস ও উৎপত্তি

তবলায় আদি ইতিহাস স্পষ্ট নয়, তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে, তবলা ১৩শ শতাব্দীতে উদ্ভূত হয়েছে। তবলা মূলত একটি দ্বিভাগীয় বাদ্যযন্ত্র, যা দুটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত – ‘দায়া’ বা ‘দায়ান’ (ডানদিকের অংশ) এবং ‘বায়া’ বা ‘বায়ান’ (বামদিকের অংশ)। দায়া সাধারণত কাঠের তৈরি হয়, আর বায়া ধাতব পাত্র থেকে তৈরি হয়। তবলার এই দ্বৈত সুরের কারণেই এটি অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র থেকে আলাদা হয়ে উঠে।

 

ভারতীয় তবলা সঙ্গীত: ঐতিহ্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষ

 

তবলার গঠন

তবলা দুটি অংশ নিয়ে গঠিত:

  • দায়া (ডানদিকের অংশ): এটি ছোট এবং উচ্চতর সুর তৈরি করে। সাধারণত কাঠের তৈরি হয় এবং এর ওপর চামড়ার পর্দা থাকে যা বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁধা হয়।
  • বায়া (বামদিকের অংশ): এটি বড় এবং গভীর সুর তৈরি করে। এটি সাধারণত ধাতু বা মাটির তৈরি হয় এবং এর ওপর চামড়ার পর্দা বাঁধা থাকে।

তবলার বিভিন্ন বাদন শৈলী

তবলায় বিভিন্ন ধরনের ছন্দ ও বাদন শৈলী আছে যা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রাগে ব্যবহৃত হয়। প্রধানত পাঁচটি তবলার ঘরানা বা শৈলী রয়েছে:

  • দিল্লি ঘরানা: এই ঘরানায় স্পষ্টতা ও বিশুদ্ধতা বেশি থাকে। দায়ান ও বায়ানের ভারসাম্য বজায় রেখে বাজানো হয়।
  • লখনৌ ঘরানা: লখনৌ ঘরানায় তবলার থাপ বা চাপের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। এই ঘরানায় ত্রিয়ের মত বিভিন্ন ছন্দের মিশ্রণ দেখা যায়।
  • আজরাড়া ঘরানা: এই ঘরানায় দায়া ও বায়ার সমানভাবে ব্যবহার করে ছন্দ সৃষ্টি করা হয়।
  • ফররুখাবাদ ঘরানা: ফররুখাবাদ ঘরানায় তবলার শব্দে মাধুর্য ও নৃত্যশিল্পের প্রভাব দেখা যায়।
  • বেনারস ঘরানা: বেনারস ঘরানায় তবলার ছন্দে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার প্রভাব বেশি থাকে।

 

আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন

 

 

তবলার মূল ছন্দ ও তাল

তবলার ছন্দের মূলে থাকে ‘তালা’ বা তাল, যা একটি নির্দিষ্ট সময় মাপকাঠি দিয়ে সংগীতের কাঠামো নির্ধারণ করে। বিভিন্ন ধরনের তাল রয়েছে, যেমন:

  • তিনতাল: সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় তাল, যার ১৬ মাত্রা আছে।
  • ঝাপতাল: ১০ মাত্রার একটি তাল, যা ধীরে বাজানো হয়।
  • রূপকতাল: ৭ মাত্রার একটি তাল, যা মৃদঙ্গ ও কীর্তনে ব্যবহৃত হয়।
  • একতাল: ১২ মাত্রার একটি তাল, যা ধ্রুপদ ও খেয়ালে ব্যবহৃত হয়।

তবলার প্রখ্যাত শিল্পী

ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে তবলার অনেক মহান শিল্পী রয়েছেন, যারা তাদের প্রতিভা ও শৈল্পিকতার মাধ্যমে তবলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের উল্লেখ করা হলো:

  • উস্তাদ আল্লারাখা: উস্তাদ আল্লারাখা তবলায় একটি কিংবদন্তি নাম। তাঁর জাদুকরী বাদন শৈলী তবলাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করেছে। রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • পণ্ডিত কুমার বোস: পণ্ডিত কুমার বোস তবলার ফররুখাবাদ ঘরানার একজন মহান শিল্পী। তাঁর বাজানোর দক্ষতা ও শৈল্পিকতা তবলা সঙ্গীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
  • জাকির হুসেন: উস্তাদ জাকির হুসেন উস্তাদ আল্লারাখার পুত্র এবং তবলার একজন অগ্রগণ্য শিল্পী। তাঁর বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধি ও প্রতিভা তবলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
  • আনিন্দো চ্যাটার্জী: পণ্ডিত আনিন্দো চ্যাটার্জী তবলায় তার সূক্ষ্মতা ও পারদর্শিতার জন্য পরিচিত। তাঁর বাজানোর শৈলী তবলা সঙ্গীতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

 

লয়ের শ্রেণীবিভাগ ও ছন্দ

 

তবলা শেখার উপায়

তবলা শেখা একটি কঠিন কিন্তু অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক প্রক্রিয়া। তবলা শেখার কিছু প্রাথমিক পরামর্শ:

  • গুরু নির্ধারণ: তবলা শেখার জন্য একজন ভালো গুরু বা শিক্ষক নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা সঠিক ভাবে তালিম ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
  • নিয়মিত অনুশীলন: তবলা শেখার মূলমন্ত্র হল নিয়মিত অনুশীলন। প্রতিদিন কিছু সময় অনুশীলনে ব্যয় করলে দক্ষতা বাড়ে।
  • বেসিক তাল ও ছন্দ শেখা: প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন তাল ও ছন্দ শেখা উচিত, যা তবলার মূলে থাকে।
  • শ্রবণ ও পর্যবেক্ষণ: বিভিন্ন তবলা বাজানোর ভিডিও ও লাইভ পারফরম্যান্স দেখে শেখা যেতে পারে।
  • উপকরণ নির্বাচন: ভালো মানের তবলা নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিক উপকরণই শেখার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে।

ভারতীয় তবলা সঙ্গীত তার গভীরতা, বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্য বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। এর ইতিহাস, গঠন, বিভিন্ন ঘরানা ও প্রখ্যাত শিল্পীদের অবদান তবলা সঙ্গীতকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তবলা শেখার প্রক্রিয়া কঠিন হলেও, সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব। তবলা সঙ্গীতের এই ঐতিহ্যবাহী ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment